রানওয়ে ধরে দ্রুতগতিতে ছুটছিল ট্যাঙ্কারটি। এটিসির তরফে তাকে গতি কমাতে বলা হয়। নির্দেশ পেতেই বিমানের কাছাকাছি গিয়ে তড়িঘড়ি ব্রেক কষে চালক। এই ঘটনা নজর এড়ায়নি ককপিটে বসে থাকা সন্ত্রাসীদের। তাঁরা আন্দাজ করে নেয়, ভারত সরকার কোনও ফন্দি এঁটেছে।
কান্দাহার বিমান অপহরণ: কোণঠাসা বাজপেয়ী,
ডোভালের কূটনীতি আর হিমস্রোত গল্প, সিনেমা দেখার আগে সত্যিটা জানুন
কীভাবে হাইজ্যাক করে কান্দাহারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিমান?
১৯৯৯। ২৪ ডিসেম্বর। পরেরদিনই খ্রিস্টমাস। দিন কয়েক পরে একবিংশ শতাব্দীতে পা রাখবে বিশ্ব। উৎসবের আমেজেই ছিল গোটা দেশ। ওই দিন নেপালের কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৮১৪ ফ্লাইট। সাধারণভাবে ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট সময় লাগত নেপাল থেকে ভারতে আসতে। কিন্তু সেই বিমানই ভারতে ফিরল ৭ দিন পর, ৩১ ডিসেম্বরে। এতদিন তাহলে কোথায় ছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানটি? আফগানিস্তানের কান্দাহারে। সেখানেই ভারতীয় বিমানকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়েছিল ৫ সন্ত্রাসী। তাদের দাবি ছিল, ২০০ মিলিয়ন ডলার ও ৩৬ জন জেলবন্দি সন্ত্রাসবাদীর মুক্তি। ৭ দিন ধরে দর কষাকষির পর কীভাবে বিমানের যাত্রীদের উদ্ধার করে এনেছিল ভারত সরকার, তা রোমাঞ্চকর কোনও সিনেমার থেকে কম নয়।
কান্দাহার হাইজ্যাক ছিল ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বড় ও সর্বশেষ বিমান অপহরণের ঘটনা। এই বিমান অপহরণের ঘটনা একদিকে যেমন দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল, তেমনই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পাকিস্তানের অশুভ আঁতাতকেও তুলে ধরেছিল। ১৯৯৯ সালেই কার্গিল যুদ্ধ হয়েছিল, যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে মাথা নীচু করে হার মানতে হয়েছিল পড়শি দেশকে। সেটা যেমন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারের সাফল্য ছিল, সেখানেই সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল বছর শেষে এই কান্দাহার বিমান অপহরণের ঘটনা। বিমানে থাকা ভারতীয় যাত্রীদের উদ্ধার করে আনতে ভারত সরকারকে মুক্তি দিতে হয়েছিল মাসুদ আজহারের মতো কুখ্যাত জঙ্গিকে, যে পরবর্তীকালে সংসদ ভবনে হামলা থেকে শুরু করে ২৬/১১ মুম্বই হামলার মূল চক্রী ছিল।
ঠিক কী ঘটেছিল ফ্লাইট আইসি৮১৪-এ, জেনে নেওয়া যাক-
১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর- ১১ জন ক্রু ও ১৭৯ জন যাত্রীকে নিয়ে কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিয়েছিল আইসি ৮১৪ ফ্লাইট। ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করে বিমানটি। সেই সময় যাত্রীদের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল। হঠাৎই পাঁচজন যাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে ক্রু সদস্যদের বলে, এই বিমান হাইজ্যাক করা হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়, যাত্রীদের খাবার যেন এখনই ফিরিয়ে নেওয়া হয়। স্কি মাস্ক পরা ওই সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ভয়ে বিমানকর্মীরা সেই নির্দেশ মানতে শুরু করে।
এরপরে বিমানের ককপিটে ঢুকে পড়তেও বেশি সময় লাগেনি। বিমানের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন দেবী সরণ সিং। তাঁকে গানপয়েন্টে রেখে সন্ত্রাসীরা শুধু একটাই কথা বলে,”পশ্চিম দিশায় উড়তে থাকো“। কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল তারা বিমানটিকে? পাকিস্তানে।
ভারতের আকাশসীমা পার করে পাকিস্তানে প্রবেশ করে বিমান। ক্যাপ্টেনকে বলা হয়, লাহোর বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করাতে। কিন্তু পাকিস্তানি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের তরফে বিমান অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। আকাশেই পাক খেতে থাকে বিমানটি। এদিকে, বিকেল ৪টে ৪০ মিনিট নাগাদ ভারতীয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে খবর আসে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের দিল্লিগামী বিমানটিকে হাইজ্যাক করে নেওয়া হয়েছে। তৎকালীন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ব্রজেশ মিশ্রের কাছে আরও দেরীতে, প্রায় এক ঘণ্টা বাদে, বিকেল ৫ টা ২০ মিনিট নাগাদ বিমান হাইজ্যাকের খবর যায়।
সন্ধে ৬টা- ভারতীয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল আইসি ৮১৪ বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। ক্যাপ্টেন দেবী সরণ সিং জানান, বিমানে জ্বালানি খুব কম। পাকিস্তানকে যেন অনুরোধ করা হয় বিমান অবতরণের অনুমতি দেওয়ার জন্য। হাইজ্যাকাররা হুমকি দিচ্ছে যাত্রীদের মেরে ফেলার।
সন্ধে সাড়ে ৬টা- ভারতীয় হাই কমিশন যোগাযোগ করে পাকিস্তানে। কিন্তু ভারতের অনুরোধ খারিজ করে দেয় পাকিস্তান। এদিকে ততক্ষণে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কথা বলেন বিমানের ক্যাপ্টেন। তিনি বোঝান যে বিমানে অত্যন্ত কম জ্বালানি রয়েছে, আর বেশিক্ষণ ওড়া সম্ভব নয়। এরপরে তারা রাজি হয় অমৃতসরে বিমান অবতরণ করাতে। সন্ধে ৬ টা ৪৪ মিনিট নাগাদ বিমানটি পাকিস্তানের আকাশসীমা থেকে অমৃতসরের উদ্দেশে রওনা দেয়।
খেলা ঘোরাতে পারত অমৃতসর-
যারা বিমানটি হাইজ্যাক করেছিল, তারা কখনওই চায়নি বিমান ভারতে অবতরণ করাতে, কারণ এতে ভারত সরকারের অভিযান চালাতে সুবিধা হত। কিন্তু কিছু ভুলের কারণে সন্ত্রাসীদের সমস্যার বদলে সুবিধাই হয়। কী সেই ভুল? যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাব।
সন্ধে ৭টা- অমৃতসর বিমানবন্দরে অবতরণ করে আইসি ৮১৪ ফ্লাইট। অনুরোধ জানানো হয় জ্বালানি ভরার। ভারত সরকার ইতিমধ্যেই একটি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ তৈরি করে। আলাদা একটি কমিটিও গঠন করা হয় , যাদের কাজই ছিল বিমানটিকে যতক্ষণ বেশি সম্ভব অমৃতসরেই আটকে রাখা।
এদিকে, বিমানে জ্বালানি ভরা হচ্ছে না। আধ ঘণ্টা কেটে যায়। হাইজ্যাকাররা এতক্ষণ যে হুমকি দিচ্ছিল, এবার তা সত্যি করে দেখায়। সতনাম সিং নামক এক যাত্রীকে ছুরি দিয়ে আক্রমণ করা হয়। পরিস্থিতি যখন জটিল হয়ে উঠছে, সেই সময় ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব দেয়। বলা হয়, অয়েল ট্যাঙ্কারের ভিতরেই পঞ্জাব পুলিশের কয়েকজনকে পাঠানো হবে। বিমানে যখন জ্বালানি ভরা হবে, তখন তারা টায়ার লিক করে দেবেন, যাতে বিমানটি আর উড়তে না পারে। পরিকল্পনা ভাল হলেও, তা বাস্তবায়ন কঠিন ছিল। সেই সময় আরও একটি প্রস্তাব দেওয়া হয় যে অয়েল ট্যাঙ্কারটি বিমানের পথ আটকে দাঁড়াবে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours