মাস খানেক আগে সামাজিক মাধ্যমে একটা পোস্ট মারাত্মক ভাবে ভাইরাল হয়। ক্যাপশন 'জরুরি ঘোষণা, বাবা-মায়েরা সতর্ক হোন'। সেখানে এক জন মহিলার ছবি দেওয়া হয়। দাগিয়ে দেওয়া হয় তিনিই বাচ্চা চোর। ঘটনাসূত্রে তখনই বারাসতের কাজীপাড়া একদিলশাহ রোডের এক ১১ বছরের নাবালকে নিখোঁজ হয়ে যায়।

ভয়ে অভিভাবকরা! সংক্রমণের মতো কীভাবে ছড়াল ছেলেধরা গুজব? কার হাত দিয়ে শুরু
ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনির সূত্র কী?

ছেলেধরা গুজব ও গণধোলাই- মাস খানেক ধরে উত্তর ২৪ পরগনায় এই বিষয়টি একেবারে সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। কোথাও ভবঘুরে, কোথাও মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি, কোথাও অপরিচিত যুবক আর সবচেয়ে চমকে দেওয়ার মতো এক সন্তানের মাকেই ছেলে ধরা সন্দেহে গণধোলাই, হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। সর্বক্ষেত্রে সন্দেহ তাঁরা ছেলেধরা। কিন্তু হাতে নেই কোনও প্রমাণই। কেবল সন্দেহের বশেই চলে চরম হেনস্থা, মারধর। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ে। আর দত্তপুকুর লোকালে এক মা-কেই হেনস্থা হতে হয়েছে।


কিন্তু কেন কীভাবে এই গুজবের সূত্রপাত? 

মাস খানেক আগে সামাজিক মাধ্যমে একটা পোস্ট মারাত্মক ভাবে ভাইরাল হয়। ক্যাপশন ‘জরুরি ঘোষণা, বাবা-মায়েরা সতর্ক হোন’। সেখানে এক জন মহিলার ছবি দেওয়া হয়। দাগিয়ে দেওয়া হয় তিনিই বাচ্চা চোর। ঘটনাসূত্রে তখনই বারাসতের কাজীপাড়া একদিলশাহ রোডের এক ১১ বছরের নাবালকে নিখোঁজ হয়ে যায়। কিন্তু পুলিশের তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, পোস্টটি ভুয়ো। তবে এক নাবালক সত্যিই নিখোঁজ হয়েছে। ঘটনার তদন্তে নামে পুলিশ। আর এই তদন্তের ভিত্তিতে যে তথ্য উঠে আসে, তা একেবারে শিউরে ওঠার মতো। জানা যায়, শিশুকে খুন করে কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর এই অভিযোগে শিশুটির জ্যেঠা আঞ্জীব নবিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযোগ, জ্যেঠাই তাঁর ভাইপোকে খুন করেছিলেন। নাবালকের মায়ের শাড়িও চুরি করেছিলেন। সেই শাড়িতে নাবালকের গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করেছিলেন তিনি। জেরায় পুলিশ আরও জানতে পারে, অভিযুক্ত ৩০ বছর ধরে কবর খোঁড়া কাজ করছেন। তিনি নাবালককে পুঁতে দিয়েছিলেন। আর পুলিশের নজর ঘোরাতে তিনিই বাচ্চা চুরির গুজব ছড়িয়ে দেন। আর তারপর থেকেই সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এই গুজব। বারাসাত থানায় রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন করে ছেলেধরা গুজবের মাস্টার মাইন্ডের নাম প্রকাশ্যে আনেন বারাসাত পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝাড়খরিয়ার।


গুজব-গণপিটুনি

যিনি খুন করেছেন, তিনিই ছড়িয়েছিলেন গুজব! কাজীপাড়ার নাবালক নিখোঁজের তদন্তে নেমে পুলিশ তেমনটাই জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সে কথায় কান দেয়নি কেউ! এরপর থেকেই একে একে বারাসতের বিভিন্ন জায়গায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির অভিযোগ ওঠে।

বনগাঁ

বনগাঁতে ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনির অভিযোগ ওঠে। মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই যুবক। সারা শরীরে ক্ষত, মারধরে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয় যুবকের। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ওই যুবক। মারধরের ঘটনায় মোট ৬ জন। আর গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ১ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

২৩ জুন. গাইঘাটা

ছেলেধরা সন্দেহে গাইঘাটায় এক যুবককে গণপিটুনি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। কয়েকদিন ধরেই ওই যুবক এলাকায় ঘুরছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্দেহ হয়। তারপর তাঁর ওপর চড়াও হন গ্রামবাসীরা। পরে পুলিশ গিয়ে ওই যুবককে উন্মত্ত জনতার হাত থেকে তাঁকে বাঁচায়। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

গোপালনগর গত সোমবারও গোপালনগরে ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনির অভিযোগ ওঠে। পরে পুলিশ গিয়ে আক্রান্তকে উদ্ধার করে। গোপালনগরে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

অশোকনগর

অশোকনগরেও ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনির অভিযোগ ওঠে। গত শনিবার এই ধরনের ঘটনা ঘটে। শনিবারের ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

খড়দহ

ছেলেধরা সন্দেহে খড়দহের রুইয়ায় নাজির হুসেন নামে এক যুবক গণপিটুনির অভিযোগ ওঠে। গুরুতর আহত হন ওই যুবক। রহড়া থানার পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে।

দত্তপুকুর লোকাল

গত মঙ্গলবার সকালে দত্তপুকুর লোকালে এক মহিলাকে ছেলেধরা সন্দেহে হেনস্থা করার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠে, ব্যাগ পুরে শিশুটিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন মহিলা। যাত্রীদের একাংশ তাঁকে ট্রেনের মধ্যেই চরম হেনস্থা করেন। চলে রেল অবরোধ। পুলিশ জানতে পারে, ওই মহিলার কোলে তারই সন্তান ছিল। রাতে মহিলার স্বামী জিআরপি-র কাছে যথেষ্ট প্রমাণ দেন, ওই মহিলা তাঁরই স্ত্রী ও শিশু তাঁরই সন্তান।

পেট্রাপোল

এসবের মধ্যে আজ, শুক্রবার আবারও পেট্রোপোলে আবারও ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। একটা গুজব, আর তার জেরে ‘নিরপরাধ’দের ওপর নির্মম অত্যাচার। নিগৃহীত হতে হচ্ছে মাকেও। ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন প্রশাসন। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ধরপাকড় চলছে। কিন্তু এর শেষ কোথায়? পুলিশের তরফ থেকে মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে ফিরছে না হাল। তাহলে উপায়? সন্তানকে নিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে অভিভাবকরা।
Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours