যদি শুধুমাত্র 'রকেট' এর কথা বলা হয়, তাহলে হ্যাঁ, টিপু সুলতানের সময় অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের একদম শেষদিকে এই জিনিস ভারতে প্রথম নির্মিত হয়েছিল।

তবে এরও অনেক আগে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার ইতিহাসে রকেটের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন, একাদশ শতকে চীনের যুদ্ধশাস্ত্র 'ইউজিং ঝংইয়াও' নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম বারুদ ও আগ্নেয় তীরের কথা পাওয়া যায়। একেই সভ্যতার ইতিহাসে রকেটবিজ্ঞানের আদিতম রূপ মনে করা হয়। পর্যটক এভিলিয়া চেলেবির বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় সপ্তদশ শতকে ১৬৩৩ সালে লায়ারি হাসান চেলেবি অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান চতুর্থ মুরাদ-এর কন্যার জন্মের সময় ইস্তাম্বুলে একটি রকেট উৎক্ষেপণ করেন। তবে এই ঘটনা নিয়ে মতভেদ আছে। বিস্তারিত তথ্য না থাকায় এবং অতিরঞ্জিত বর্ণনার কারণে এটাকে বিজ্ঞান না ধরে কিংবদন্তী হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।

তাই নিশ্চিত ইতিহাসের কথা ভাবলে টিপু সুলতানের আমলের রকেটকেই পৃথিবীর প্রথম ব্যবহৃত রকেট হিসেবে গণ্য করা যায়।

তবে এই রকেটের সাথে মানববাহী মহাকাশগামী রকেটের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই (যদিও উভয়েই নিউটনের তৃতীয় সূত্রকেই মূলনীতি হিসেবে ব্যবহার করে)। টিপু সুলতানের রকেট ছিল একদমই ছোটমাপের- বল্লমের আকারের যা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মহীশূরের যুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল।

এই ধরণের যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত রকেটের আধুনিক যুগের একটি উদাহরণ হল- পিনাকা। এগুলি ছোটমাপের মিসাইলের মত স্বল্প দূরত্বে আঘাত হানতে পারে।

অপরদিকে মানববাহী মহাকাশগামী রকেট আকারে অতি-বৃহৎ ও অত্যন্ত জটিল একটি সিস্টেম। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের আগে মহাকাশগামী রকেটের অস্তিত্ব ছিল না। তবে বহুকাল ধরেই রকেটের বিবর্তন ঘটছিল এবং রকেট ক্রমশঃ উন্নত হয়ে উঠছিল। কখনও তা হয়েছিল যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে, কখনও প্রদর্শনীর জন্য, কখনও বা অনুসন্ধিৎসু গবেষকদের গবেষণার অংশ হিসেবে।

রকেটবিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ধরা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানির আবিষ্কার V-2 রকেটকে। ১৯৪৪ সালে এই রকেট ১৭৬ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত গিয়েছিল। এটিই মহাকাশে পৌঁছানো মানুষের তৈরি প্রথম বস্তু। যদিও এই রকেটও ছিল একটি যুদ্ধাস্ত্র। এটি নাৎসি জার্মানি থেকে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে গ্রেট ব্রিটেনে হামলা করতে পারত।

আর ইতিহাসের প্রথম মানববাহী মহাকাশগামী রকেট হল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভস্তক-K যা ভস্তক-১ মহাকাশযানকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছিল। এতে করেই ১৯৬১ সালে সোভিয়েত মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিন ৩২৭ কিমি উচ্চতায় যান এবং পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে ফিরে আসেন। ইউরি গ্যাগারিনই হলেন মানবসভ্যতার ইতিহাসে মহাকাশগামী প্রথম মানব।

বাঁয়েঃ ভস্তক-কে রকেট
ডানে ওপরেঃ ভস্তক-১ মহাকাশযান রকেটে যুক্ত অবস্থায়
ডানে নীচেঃ ভস্তক-১ মহাকাশযান পৃথিবীতে ফেরার পর

এই ধরণের মানববাহী মহাকাশগামী রকেটগুলি প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত জটিল, আকারে বৃহৎ এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী।

উদাহরণ হিসেবে এখনও পর্যন্ত ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট স্যাটার্ন-৫ এর কথা বলা যেতে পারে। এই রকেটের সাহায্যে উৎক্ষেপিত অ্যাপোলো মহাকাশযানে চেপেই মানুষ চাঁদে পাড়ি দিয়েছিল। ১০ মিটার ব্যাস ও ১১০.৬ মিটার উচ্চতার এই রকেটের মোট ভর ছিল ২৯৭০ টন। এটি নিম্ন পার্থিব কক্ষপথে ১৪০ টন ও চাঁদের দিকে ৪৮.৬ টন ভর পাঠাতে পারত। একে মহাশক্তিশালী ৫ টি রকেটডাইন এফ-১ ও ৬ টি রকেটডাইন জে-২ ইঞ্জিন শক্তি দিত। জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার হত অতিশুদ্ধ কেরোসিন ও অতিশীতল অবস্থায় রাখা তরল অক্সিজেন।

স্যাটার্ন-৫ রকেটের নীচের দিকে থাকা কয়েকটি এফ-১ ইঞ্জিন (সামনে ওয়ারনার ভন ব্রাউন, ভি-২ ও স্যাটার্ন-৫ রকেটের স্রষ্টা, আমেরিকান মহাকাশ প্রোগ্রামের জনক)

আর ভারতের প্রথম মানববাহী মহাকাশগামী রকেট হতে চলেছে GSLV Mk3। এটি একবিংশ শতকে নির্মিত হয়েছে। ২০১৭ সালে এর প্রথম কক্ষীয় উড়ান সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ভারতে ১৯৬০ এর দশক থেকে শুরু হওয়া গত ৬ দশকব্যাপী নিরন্তর মহাকাশপ্রযুক্তি গবেষণাই এই সাফল্যের ভিত্তিনির্মাণ করেছে।

এটি ১৩ তলা বিল্ডিং-এর মত উঁচু (৪৩.৪৩ মিটার), ব্যাস ৪ মিটার, ওজন ৬৪০ টন। এই রকেট নিম্ন পার্থিব কক্ষপথে ১০ টন ভর নিয়ে যেতে পারে। এতে ২ টি এস-৪০০ ইঞ্জিন, ২ টি বিকাশ ইঞ্জিন ও ১ টি CE-20 ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়।

CE-20 ইঞ্জিন (এতে অতিশীতল অবস্থায় রাখা তরল হাইড্রোজেন ও তরল অক্সিজেন জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়)


CE-20 ইঞ্জিন (এতে অতিশীতল অবস্থায় রাখা তরল হাইড্রোজেন ও তরল অক্সিজেন জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়)

এই রকেট 'গগনযান' মহাকাশযানে করে ভারতীয় মহাকাশচারীদের মহাকাশে নিয়ে যাবে।



Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours