‘মা, আমারে পার্লারে কাম দেওয়ার কথা বইলা সোহাগ আর কালু ইন্ডিয়ার খারাপ জায়গায় দেড় লাখ টাকায় বেইচা ফেলছে।’ মোবাইল ফোনে মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগের পর এমন কথা শুনে মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। শুভাকাঙ্ক্ষী রূপে পাশে এসে দাঁড়ানো ওই ব্যক্তির কাছে ছুটে যান ওই নারী। তাঁরা বলেন, ‘এসব বাজে কথা, তোমার মেয়ে ভালো আছে।’ এরপর মেয়ের আর ফোন আসে না। এখন পর্যন্ত মেয়েকে ফিরে পাননি বস্তিবাসী ওই নারী। তবে ভারত থেকে নিজের মেয়েকে উদ্ধার করে দেশে ফিরে আসা একই বস্তির এক নারীর কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন, তাঁর মেয়ে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কিষানগঞ্জের পাঞ্জিপাড়ায় একটি নিষিদ্ধ পল্লীতে বন্দিদশায় রয়েছে।

রাজধানীর পল্লবী থানাধীন কালশী এলাকার শাহপরান বস্তির একটি ঘরে সম্প্রতি যখন ওই নারীর সঙ্গে কথা হয়, তখন তিনি শুধু মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছিলেন। তিনি জানান, পল্লবী থানায় অভিযোগও করেছেন তিনি।

গত ১৬ আগস্ট র‌্যাব অভিযুক্ত সেই কালু, সোহাগ ওরফে নাগিন সোহাগ ও বিল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া তথ্যের সূত্রে এবং ভুক্তভোগী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পাচারকারীচক্রে রাজিয়া, আসমা, শামসুল, আলী, ভাগিনা বাবুসহ আরো কয়েকজন রয়েছেন। তাঁরা গত কয়েক বছরে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে দরিদ্র পরিবারের ২০০ মেয়েকে ভারতের নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি করেছেন।

কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় লজ্জা-সংকোচ পেছনে ফেলে ভুক্তভোগী অন্য পরিবারগুলোও প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু কালশীর শাহপরান বস্তিরই শতাধিক নারীকে ফাঁদে ফেলে ভারতে পাচার করেছে কালু-সোহাগ চক্র।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পাচারকারীচক্রটি প্রভাবশালী হওয়ায় অভিযোগ পেয়েও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি র‌্যাব কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পরেও তদন্তে পাচারের বিস্তারিত বেরিয়ে আসছে না। ভারতে বন্দি থাকা মেয়েদের ফেরত আনার ব্যাপারেও নেই কোনো উদ্যোগ।

জানতে চাইলে র‌্যাব ৪-এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চক্রটি আরো অনেক মেয়েকে পাচার করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। ফিরে আসা মা-মেয়েও দেখেছে। এই চক্রে আরো কয়েকজন আছে। আমরা মামলাটির তদন্তভার পেতে আবেদন করেছি। তদন্ত পেলে সব বিষয় খতিয়ে দেখা হবে।’

মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আকুতি : শাহপরান বস্তির ভুক্তভোগী নারী বলছিলেন, চলতি বছরের ৬ এপ্রিল সোহাগ ও তাঁর মামা কালু সাতক্ষীরায় পার্লারে কাজে দেওয়ার কথা বলে তাঁর মেয়েকে নিয়ে যান। গন্তব্যে পৌঁছার পর কালুর মোবাইল ফোন থেকে ভিডিও কলে মেয়ের সঙ্গে কথা হয়। সোহাগ এসে একদিন মেয়ের বেতনের নাম করে তাঁর হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন। আরেক মাসে দেন আড়াই হাজার টাকা। সঙ্গে একটি মোবাইল ফোনসেট। মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে যখন জানতে পারেন যে তাকে ভারতের নিষিদ্ধ পল্লীতে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন কালু ও সোহাগ, তখন তাঁদের কাছে ছুটে যান। মেয়েকে ফিরে পেতে আকুতি জানান। কিন্তু কোনোভাবেই তাঁর মেয়ের হদিস পাচ্ছিলেন না। মান-সম্মান হারানোর ভয়ে কাউকে কিছু জানাতেও পারছিলেন না। এরই মধ্যে তিনি খবর পান, ভারতে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েকে উদ্ধার করে ফিরেছেন তাঁদের বস্তিরই আরেক নারী। পরিচিত সেই নারীর কাছে যেতেই তিনি বলেন, ‘তোমার মাইয়ারে দেখছি। আমার মাইয়ারে যেখান থেইকা উদ্ধার করছি, সেইখানে। অনেক কষ্টে আছে। ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কিষানগঞ্জের পাঞ্জিপাড়ায় আছে সে।’ তিনি জানান, তাঁর স্বামী অসুস্থ। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কারচুপির কাজ করে অনেক কষ্টে সংসার চলছে তাঁদের। বড় মেয়েটির বিয়ে হয় চার বছর আগে। স্বামী নির্যাতন করার কারণে সম্পর্ক ভেঙে যায়। এর পর থেকেই এক সন্তান নিয়ে মেয়েটি তাঁর কাছেই ছিল। সোহাগ বস্তিতে এসে তাঁর মেয়েকে পার্লারে কাজ দেবেন বলে নিয়ে যান।

ওই নারী বলেন, ‘আমি থানায় অভিযোগ করছি। তারা মামলা না নিয়া খালি জেরা করে। আমি আমার মাইয়ারে ফিরত চাই।’

মেয়েকে উদ্ধার করে ফিরেছেন এক মা : শাহপরান বস্তির অদম্য সেই মা পরিচয় লুকিয়ে নিজেই পাচার হয়ে সাড়ে চার মাস নিষিদ্ধ পল্লীতে বন্দি থেকে মেয়েকে উদ্ধার করে গত ১৭ জুলাই দেশে ফিরেছেন। কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি ও তাঁর মেয়ে পাচারকারীদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছেন। তাঁরা বলছিলেন, শাহপরান বস্তিরই দুই নারীকে তাঁরা পাঞ্জিপাড়ার সেই নিষিদ্ধ পল্লীতে দেখেছেন।

ওই নারী বলেন, তাঁর মেয়ে পাচার হওয়ার ঘটনা জানিয়ে গত ১৭ জানুয়ারি পল্লবী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সন্দেহভাজনদের নাম জানালেও পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শেষে পরিচয় গোপন করে কালুর কাছে বিদেশে কাজ চেয়ে স্বেচ্ছায় পাচার হন তিনি। সাতক্ষীরার বিল্লাল এবং ভারতের শামসুলের মাধ্যমে নয়াদিল্লির জিবি রোডের নিষিদ্ধ পল্লীতে পৌঁছে যান তিনি। তবে সেখানে মেয়েকে পাননি। তিনি ছোট ছোট আবদ্ধ কক্ষে বাংলাদেশি কিছু নারীকে দেখেছেন। সাড়ে চার মাস পর কৌশলে সেখান থেকে পালান তিনি। এরই মধ্যে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয় ভারতীয় এক যুবকের সঙ্গে। তাঁর সহায়তায় মেয়ের খোঁজ পান দক্ষিণ দিনাজপুরের পাঞ্জিপাড়ায়। স্থানীয় চেয়ারম্যানের সহায়তায় সেখানকার নজরুলের পল্লী থেকে মেয়েকে উদ্ধার করেন তিনি।

জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, ‘যে মায়ের কথা বলছেন, তাঁর মেয়েকে পাঞ্জিপাড়ার একটা ঘরে দেখলাম। খারাপ অবস্থা। কথা বলতে পারি নাই। আমার কিছু করার ছিল না। নিজের মেয়েরেই আনতে পারছিলাম না।’ তিনি আরো বলেন, ‘মেয়েকে উদ্ধার করে ফিরে আসার পর শুনেছি, বস্তির আরো দুই মেয়েকে সোহাগ নিয়ে যাবে। আমি তখন ওই দুই পরিবারের কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলি। ওই দুজন আর যেতে রাজি হয়নি। বস্তির অনেক মেয়ে নিখোঁজ আছে।’ তিনি বলছিলেন, বস্তির সবাই জানে বাউনিয়া বাঁধের কালু আর তাঁর ভাগ্নে সোহাগ মেয়েদের চাকরি দেওয়ার কথা বলে নিয়া যান।

ফিরে আসা ১৮ বছরের মেয়েটি বলেন, পার্লারে কাজের কথা বলে সাতক্ষীরা নেওয়ার পর বিল্লাল যখন আরো তিনটা মেয়ের সঙ্গে নৌকায় তাঁকে পার করছিলেন, তখন জানতে পারেন তাঁদের গন্তব্য ভারত। তখন মাঝির মোবাইল ফোন থেকে বাবাকে কল দিয়ে জানান। এরপর ওই পারে আলী নামের একজন তাঁদের চারজনকে নজরুলের কাছে নিয়ে যান। পাঞ্জিপাড়ায় নজরুলের নিয়ন্ত্রণাধীন নিষিদ্ধ পল্লীতে আরো মেয়ে আছে। বাংলাদেশের মেয়েও আছে।

স্ত্রীকে পাচারের অভিযোগ রিকশাচালকের : শাহপরান বস্তির এক রিকশাচালক অভিযোগ করেন, কালু ও সোহাগদের চক্র তাঁর স্ত্রীকে পাচার করেছে। মাসখানেক আগে তিনি ঘটনাটি জানতে পারেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আট মাস ধরে কালু আর সোহাগ আমার স্ত্রীকে ভালো চাকরি দিয়ে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে আসছিল, কিন্তু আমি রাজি হই নাই। একদিন আমার স্ত্রী কিছু না বইল্যাই বাসা ছেড়ে চলে যায়।’ তিনি স্ত্রীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি বলে জানান।

বস্তির বাসিন্দাদের অভিযোগ, সোহাগ, বাবুসহ কয়েকজন যুবক বস্তিতে ঘুরে মাদক বিক্রি করেন। যেসব ঘরে তরুণী আছে, সেখানে গিয়ে কৌশলে সম্পর্ক তৈরি করেন। আর্থিক অনটনে থাকা এই তরুণীদের বিনা খরচে ভারতের বিভিন্ন মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারে চাকরির প্রলোভন দিয়ে পাচার করেন তাঁরা।

ভুক্তভোগীরা জানান, সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্তবর্তী গ্রামে চারটি ‘সেফ হাউসে’ নারীদের রাখেন পাচারকারীচক্রের বিল্লাল। কালু, সোহাগসহ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের দালালরা সেখানে মেয়েদের নিয়ে যান। একদিন অবস্থানের পর নৌকায় করে ইছামতী নদী পার হয়ে ভারতের বসিরহাট সীমান্তবর্তী গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় ওই মেয়েদের। এ কাজ করেন চক্রের এজেন্ট আলী ও শামসুল। বসিরহাট থেকে কৃষ্ণনগর হয়ে কিষানগঞ্জের পাঞ্জিপাড়া, এরপর আরেকটি রুটে ট্রেনে করে দিল্লিতে নেওয়া হয় তাদের।

জানতে চাইলে পল্লবী থানার ওসি পারভেজ ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কালু, সোহাগ ও বিল্লালের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ডে আনা হয়। রিমান্ড শেষে কালু ও বিল্লাল ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই চক্র শাহপরান বস্তি থেকে আরো মেয়েকে পাচার করেছে বলে শুনছি। তবে পরিবারগুলো অভিযোগ দিচ্ছে না। অভিযোগ পেলে মামলা করা হবে।’


Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours