কলকাতা :সারাটা দিন মোবাইলের দোকানেই ব্যস্ত থাকত। কিন্তু তারই ফাঁকে খোঁজ রাখত শহরের কোন এটিএম কাউন্টারে নেই নিরাপত্তা রক্ষী। এলাকা চষে নিত সে। আর পুরো ‘ডিটেইল’ দিয়ে দিত বাকি দুই সঙ্গীকে! বিদেশ থেকে আনা একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমেই লক্ষ লক্ষ টাকা নিমেশে হাপিস করেছে ওরা। এটিএম জালিয়াতির চক্রী (Kolkata ATM Fraud Case) বছর তিরিশের চার যুবকের কীর্তিতে হতবাক দুঁদে তদন্তকারীরাও।
শহরের এটিএম জালিয়াতি কাণ্ডে ইতিমধ্যেই চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সুরাট থেকে গ্রেফতার মনোজ গুপ্তা, নবীন গুপ্তা। এঁরা মূলত দিল্লির বাসিন্দা। কলকাতা থেকে গ্রেফতার বিশ্বদীপ রাউত ও আব্দুল সইফুল মণ্ডল। তাদের জেরায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য
জানা গিয়েছে, ডার্ক ওয়েবে বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল ব্ল্যাক বক্স। সেই ব্ল্যাক বক্সের মাধ্যমেই এটিএম-এর সঙ্গে ব্যাঙ্কের সার্ভারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ভূতুড়ে কায়দায় টাকা গায়েব করা হয়েছিল। রবিবার সুরাট থেকে ধৃত দুই অভিযুক্ত ডার্কওয়েভে এই বিশেষ যন্ত্র নিয়ে এসেছিল।
কীভাবে ব্ল্যাক বক্সের মাধ্যমে জালিয়াতি হয়?
দিল্লির বাসিন্দাদের জেরা করে জানা গিয়েছে, ডার্ক ওয়েভে বিশেষ যন্ত্র তারা আমদানি করেছিল। এটিকেই তারা বলে ব্ল্যাক বক্স। তার মাধ্যমেই ভূতুড়ে কায়দায় টাকা গায়েব হত। কীভাবে সম্ভব?
চাবি দিয়ে প্রথমে এটিএমের হুড খোলা হয়।
ভিতরের ইউএসজি পোর্টে ওই ব্ল্যাক বক্সটিকে বসিয়ে দিতে হয়।
ব্ল্যাক বক্স পুট হয়ে যাওয়ার পরই গোটা এটিএমের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে পেয়ে যায় জালিয়াতরা।
এটিএমের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে যে মেশিনটি রিপিয়ারিং মুডে চলে গিয়েছে।
এরকম লেখা থাকলেও ওই অবস্থায় টাকা বের করা সম্ভব এবং সেই ব্ল্যাক বক্স মোবাইলের মাধ্যমেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
তারপর ‘get cash’ বোতাম চাপ দিলেই টাকা বেরিয়ে আসবে।
এটিএমের ক্যাশ ট্রে অর্থাত্ টাকার বেরনোর কন্ট্রোলটিও জালিয়াতদের কাছে চলে যায়।
ঠিক এই কলকাতা থেকে গত কয়েক দিনে ২ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
চিন ছাড়াও অনান্য অনেক দেশ থেকে বেআইনি পথে এই যন্ত্র আমদানি করত।
সুরাট থেকে কলকাতায় এসে তারা এই পদ্ধতিতে জালিয়াতি করেছে। তদন্তে আরও জানা গিয়েছে, কলকাতার দুই যুবক বিশ্বদীপ ও আব্দুল বাকি দুই দিল্লির যুবককে এই কাজে সাহায্য করত। তাঁদের নিরাপদ জায়গায় হোটেল খুঁজে দিত। এলাকা চষে খোঁজ দিত নিরাপত্তাবিহীন এটিএমের ঠিকানাও। কমিশনের বিনিময় নিজেদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ভাড়াও দিয়েছিল তারা। অর্থাত্ মনোজ ও নবীনের লোকাল গাইডেন্স হিসাবে কাজ করত ওরা।
গত কয়েক দিনে নিউমার্কেটের একটি এটিএম থেকে এভাবে ১৮ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। যাদবপুর থানা এলাকার একটি এটিএম থেকে ১৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা এবং কাশীপুর থানা এলাকার একটি এটিএম থেকে ৭ লক্ষ টাকা তোলা হয়েছে।
তদন্তকারীরা প্রথম থেকে সন্দেহ করছিলেন, নতুন একটি যন্ত্রের সাহায্যে চলছে এই জালিয়াতি। যার সাহায্যে এটিএম থেকে টাকা বের করে নিচ্ছে একটি চক্র। চুরির সময় ব্যাঙ্কের সঙ্গে লিঙ্ক ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে এটিএম-এর। এটিএম থেকে টাকা চুরি হলেও কোনও গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা যাচ্ছে না। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ২৫ এবং ২৮ মে তিনটি পৃথক মামলা দায়ের হয়েছে।
গোয়েন্দাদের নজরে ছিলেন হিতাচি (HITACHI)-র কর্মীরা। অর্থাত্ এটিএমে টাকা ভরার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাই গোয়েন্দাদের নজরে। নিউ মার্কেটের একটি এটিএম থেকে কয়েকদিন আগে টাকা গায়েব হয়েছিল, সেই এটিএম কাউন্টারটি ভালভাবে খতিয়ে দেখেন সাইবার সেলের কর্মীরা।
তবে পুলিশকে ভাবাচ্ছিল একটি বিষয়। এর আগে কলকাতা বা এ রাজ্যে এই প্রযুক্তিতে এটিএম থেকে হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা নজরে আসেনি। এর আগে দিল্লি ও সংলগ্ন এলাকার অবশ্য এই ধরনের প্রতারণা রয়েছে। দিল্লি, ফরিদাবাদ, গুরুগ্রাম-সহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তদন্তকারীরা। ফরিদাবাদেও একই কায়দায় এটিএম লুঠের ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার সঙ্গে কথা বলতেও যান তদন্তকারীরা।
এদিকে, সিসিটিভির ফুটেজকে হাতিয়ার করে পুলিশের র্যাডারে চলে আসে কসবার মোবাইল ব্যবসায়ী বিশ্বদীপ। আর এসবের মাঝেই তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে মোটা অঙ্কের টাকা। সেই টাকার লেনদেনের সূত্র ধরে তদন্ত এগোতেই খুলতে থাকে জট! ধৃতদের জেরা করে আরও অনেক তথ্য উঠে আসবে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours