কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের গ্রাফ এখনও ঊর্ধ্বমুখী। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, পুজোর পরে দ্বিতীয় সংক্রমণের ঢেউ সুনামির মতো আছড়ে পড়বে। কিন্তু তাতেও হুঁশ ফিরছে কই! গণপরিবহণ থেকে মাছের বাজার, নিউ মার্কেট থেকে শপিং মল বা জুতোর দোকানে ভিড় উপচে পড়ছে। চিকিৎসক আর যাঁদের বাড়িতে এই অসুখ একবার ঢুকে পড়েছে তাঁরা ছাড়া কেউই বোধ হয় অসুখটির ভয়াবহতার কথা কল্পনাও করতে পারছেন না।
এই মারাত্মক চরিত্রের ভাইরাসের হাত এড়ানোর একমাত্র উপায় সঠিক পদ্ধতিতে মাস্ক পরা, ভিড় এড়িয়ে চলা এবং পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা। কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা বা সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আবিষ্কার হলেও সঠিক ভাবে মাস্ক পরাকে আমাদের জীবনের অঙ্গ করে নেওয়া উচিত, এমনই পরামর্শ দিলেন কনসালট্যান্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ ঘোষদস্তিদার।
এক দল ডাক্তারি পড়ুয়া সম্প্রতি দেশের ১৯টি শহরের ৩০টি বাজার এলাকায় সমীক্ষা করে দেখেছেন, ক্রেতা ও বিক্রেতাদের প্রতি ৪ জনের মধ্যে ১ জন মাস্ক পরেননি। আবার যাঁরা মাস্ক পরেছেন, তাঁদের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের মাস্ক নাকের তলায়। ঠিক এই কারণেই লাগাতার লকডাউন করেও কোভিড-১৯ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া আটকানো যাচ্ছে না।
যাঁরা গরমের দোহাই দিয়ে মাস্ক পরেন না তাঁদের বোঝা উচিত, গরমে যদি শার্ট-প্যান্ট বা শাড়ি-সালোয়ার পরা যায় তা হলে মাস্ক পরতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিশ্বজিৎ ঘোষদস্তিদারের মত, কোভিড-১৯ ভাইরাস উপলক্ষ মাত্র। এই ধরনের অতিমারির মূলে আছে মানুষের বদ অভ্যাস। তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণ থেকে কোভিড-১৯ অসুখটির উৎপত্তি। উহানের মাংসের বাজার থেকে ভাইরাস ছড়িয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। আজকের দিনে যখন প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে চিনে বন্য প্রাণীর মাংস খাওয়ার ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক। অসুখটা ছড়িয়ে পড়ার জন্যে দায়ী সভ্য মানুষের অদ্ভুত আচরণ।
নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মানুষের চরিত্রগত ও ব্যবহারগত অসুখ বলে মনে করেন বিশ্বজিৎ। আচার ব্যবহার সংযত না করলে রোগ ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো মুশকিল। সাবধান থাকলে কোভিড-১৯ ভাইরাসের ছোঁয়াচ কিছুটা বাঁচিয়ে চলা যায়। অবশ্য যাঁরা রোগীদের চিকিৎসা ও অন্যান্য পরিষেবা দিতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের কথা আলাদা। রোগের লক্ষণ দেখেও যাঁরা গ্রাহ্য করেন না, বাড়াবাড়ি না হলে টেস্ট করানো বা ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবেন না তাঁদের মৃত্যুহার তুলনামূলক ভাবে বেশি।
চেস্ট মেডিসিনের চিকিৎসক অনির্বাণ বিশ্বাস জানালেন, হার্টের অসুখ, স্ট্রোক বা হাঁপানির মতো নভেল করোনা ভাইরাস সহজে আমাদের ছেড়ে যাবে না। তবে এই অসুখকে আটকে দেওয়ার অস্ত্র আমাদের নিজেদের হাতেই আছে। প্রথম এবং প্রধান অস্ত্র বাইরে বেরলেই মাস্ক পরা, মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় রাখা।
নাক-মুখ ঢাকা দেওয়া মাস্ক পরে এই রোগের বিস্তার অনেকাংশে আটকে দেওয়া যায় বলে অনির্বাণ বিশ্বাস মনে করেন। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ দেবকিশোর গুপ্ত জানান, কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ এড়াতে মাস্কের কোনও বিকল্প নেই। বাড়ির বাইরে বেরলে অবশ্যই মাস্ক পরা উচিত। ত্রিস্তর-যুক্ত মাস্ক পরলে ভাইরাসকে অনেকাংশেই আটকে দেওয়া যায়। কাপড়ের বাহারি মাস্কের থেকে ত্রিস্তর-যুক্ত মাস্ক ছোঁয়াচ বাঁচাতে অনেক বেশি কার্যকর। নাক মুখ সম্পূর্ণ ভাবে ঢেকে মাস্ক পরা দরকার। একই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখা উচিত, যখন তখন মাস্ক খোলা পরা বা মাস্ক নামিয়ে খাবার খাওয়া ঠিক নয়। মাস্ক খোলা-পরার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া বা স্যানিটাইজ করা উচিত।
বিশ্বজিৎ ঘোষদস্তিদার জানালেন, ভ্যাকসিন এলেই যে নভেল করোনা ভাইরাস ভ্যানিশ হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়। কোভিড-১৯-এর কার্যকর টিকা কবে আসবে এবং সবাই সেই টিকা নেওয়ার সুযোগ পাবেন কি না, সে বিষয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তার থেকে অনেক সহজ কাজ নিজেদের অভ্যাস পালটে ফেলা। এ ছাড়া টিকা এলেও মাস্ক পরার অভ্যেস ছাড়লে চলবে না। পোশাক পরার মতোই মাস্ককে সর্বক্ষণের সঙ্গী করে নিতে হবে। এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমাদেরই হাতে। সিগারেট ছেড়ে দেওয়া যেমন কঠিন কাজ, কিন্তু মনের জোরে এই নেশা ছাড়লে লাভবান হওয়া যায়। তেমনই মাস্ক পরাকে মানুষের মজ্জাগত করে তুলতে পারলে কোভিড-১৯-এর মহামারিকে আটকে দেওয়া যাবে।
বিশ্বজিতের মত, ''মানুষ অভ্যাসের দাস। একটু কষ্ট করে মাস্ক দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখলে ড্রপলেট-সহ সব সংক্রমণই প্রতিরোধ করা যাবে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, চিকেন পক্স, টনসিলাইটিসের মতো সংক্রামক অসুখের ঝুঁকিও অনেক কমবে। মাস্ক পরার মূল উদ্দেশ্য বাতাসে ভেসে থাকা ভাইরাস আটকে দেওয়া।'' তাই মাস্ক পরাকে জীবনের অঙ্গ করে নিতে পারলে মানুষ অত্যন্ত লাভবান হবেন বলে পরামর্শ বিশ্বজিতের।
সুতির ত্রিস্তর-যুক্ত মাস্ক পরলে বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে রোজ মাস্ক কেচে দিতে হবে, বদল করে পরতে হবে। তবে সার্জিক্যাল মাস্ক রোজ একটা করে পরাই ভাল। মাস্ককে জীবনের অঙ্গ করে নিতে হবে। মাস্ক না পরে বাইরে যাওয়া লজ্জার ব্যাপার, এই ধারণা মজ্জায় মিশিয়ে নেওয়াই করোনা-মুক্তির অন্যতম হাতিয়ার। ভ্যাকসিন, ওষুধ বা নামী হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার, ভেন্টিলেটর কিংবা একমোর সাহায্যে চিকিৎসা করার থেকে করোনা আটকাতে অনেক বেশি কার্যকর মাস্ক। এর সুদূরপ্রসারী সুফল পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে।
মহামারি বা অতিমারি একবার হয়েই শেষ হয়ে যায় না। ঘুরে ফিরে আসে। মাস্ককে জীবনের অঙ্গ করতে পারলে ভবিষ্যতের মহামারিও আটকে দেওয়া যাবে। বিশ্বজিৎ ঘোষদস্তিদার জানালেন, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে শুধুমাত্র মাস্ক পরার উপর জোর দিয়েই কোভিডের বিস্তার আটকে দেওয়া গিয়েছে। করোনা ভাইরাসকে আটকে দেওয়া শুধুমাত্র ডাক্তার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের কাজ নয়, দায়িত্ব সকলেরই। কেবল সঠিক নিয়ম মেনে মাস্ক পরে আর ভিড় এড়িয়ে আটকে দেওয়া যায় ভাইরাসের সংক্রমণ। নাক মুখ ঢেকে রোগ প্রতিরোধ করুন, ভাল থাকুন।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours