শেষমেশ থেমে গেল লড়াই। সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ পুত্র অভিজিত্ মুখোপাধ্যায় টুইট করে জানালেন, বাবা আর নেই। কয়েক দিনের রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে শেষমেশ হার মানলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে কেন্দ্রের তরফে।
আজ সকালেই সেনা হাসপাতাল তরফে মেডিক্যাল বুলেটিন জারি করে জানানো হয়, আরও অবস্থার অবনতি হয়েছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির। আগেই গভীর কোমায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। দেওয়া হয় ভেন্টিলেটর সাপোর্ট। বাড়তে থাকে ফুসফুসের সংক্রমণও। গত শনিবার মেডিক্যাল বুলেটিনে প্রণবের সামান্য উন্নতির কথা শুনিয়েছিলেন চিকিত্সকরা। সে দিন হাসপাতাল তরফে জানানো হয়েছিল, কিডনি আগের তুলনায় ভাল কাজ করছে। শরীরের রক্ত সঞ্চালন স্থিতিশীল।
গত ৯ অগস্ট বাড়ির বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পান প্রণব মুখোপাধ্যায়। তারপরই দিল্লির কনটেনমেন্ট সেনা হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। করোনা পরীক্ষা করানো হলে পজেটিভ রিপোর্ট আসে। টুইটারে সে রিপোর্ট জানিয়ে তাঁর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের সতর্কও করে দেন তিনি। এরপর মাথায় অস্ত্রোপচার হয় তাঁর। তারপর থেকেই কোমায় আচ্ছন্ন ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর মৃত্যুতে শোকমগ্ন গোটা দেশ।
প্রণবের মৃত্যুতে কার্যত পিতৃহারা বীরভূমের কীর্ণাহার। এই গ্রামের মেঠো পথ, ভাঙা সাঁকো পেরিয়ে সোজা রাষ্ট্রপতি ভবন, এক দীর্ঘ বর্ণময় জীবন রেখে গেলেন কীর্ণাহারের আদরের পল্টু। জন্ম ১৯৩৫ সালে ১১ ডিসেম্বর। বাবা কামদা কিঙ্কর মুখোপাধ্য়ায় ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্যও ছিলেন। সেই সূত্রেই প্রণবের রাজনীতির হাতেখড়ি ঘর থেকেই।
১৯৬৯ সালে মেদিনীপুর বাই ইলেকশনে প্রচারের জোরে প্রণব মুখোপাধ্যায় একা হাতে জিতিয়ে দিয়েছিলেন ভি কে কৃষ্ণ মেননকে। তারপরই ইন্দিরা গান্ধীর নজরে আসেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। কার্যত ইন্দিরা গান্ধী হাত ধরেই জাতীয় কংগ্রেসে প্রবেশ তাঁর। তারপর ১৯৬৯ থেকে ২০০২ টানা রাজ্যসভার সদস্য বাংলার প্রণব মুখোপাধ্যায়। ইন্দিরা ঘনিষ্ঠ প্রণব মুখোপাধ্যায় ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা ক্যাবিনেটের কেন্দ্রীয় ডেপুটি শিল্প উন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন।
১৯৭৫-৭৭ যখন দেশে এমারজেন্সি তখনও ইন্দিরা ক্যাবিনেটে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৭৭ সালে দেশে ক্ষমতা বদলের পর "জনতা সরকার" শাহ কমিশন নিযুক্ত করে সেখানেও নাম জড়িয়েছিল তাঁর। ১৯৭৯ সালে রাজ্য়সভায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ডেপুটি নেতা হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৮০ সালে জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্যসভার প্রধান নেতা।
১৯৮২ থেকে ৮৪, একাধিক ক্য়াবিনেট পদের পরে অর্থমন্ত্রী হন প্রণব মখোপাধ্যায়। তাঁর আমলেই ভারতের প্রথম IMF লোনের শেষ কিস্তি চুকিয়েছিল ভারত। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসেবে মনমোহনের নিযুক্তিপত্রে সই করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়।
ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি রাজীব গান্ধীর থেকে অনেক অভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও দায়িত্ব নিয়েছিলেন ইন্দিরা পুত্র। রাজীব আমলে ক্যাবিনেট থেকে বাদ পড়েন তিনি, তাঁকে পাঠানো হয় পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সামলাতে।
১৯৮৬ সালে নিজের দল প্রতিষ্ঠা করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। নাম দেন রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস। তিন বছর পরেই ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর মধ্যস্থতায় ফের জুড়ে যায় দুই কংগ্রেস। ঘরওয়াপসি হয় তাঁর। পরে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তাঁর উত্তর ছিল, "৭, আরসিআর কখনওই আমার গন্তব্য ছিল না।" ৭ আরসিআর প্রধানমন্ত্রী বাসভবনের ঠিকানা।
রাজীব গান্ধী মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে ফের বদল আসে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে। নরসীমা রাওর আমলে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসাবে ইন্ডিয়ান প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন প্রণব মুখোপধ্যায়। নরসীমার সময়েই ১৯৫৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিদেশমন্ত্রকের দায়িত্বভার সামলেছেন তিনি।
সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় ১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সারা ভারত জাতীয় কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০০০ সালে ফের পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হন প্রণব তিনি। তারপর টানা ১০ বছর বহাল ছিলেন এই পদে। জঙ্গীপুর লোকসভা থেকে জিতে ২০০৪ সালে লোকসভার নেতা হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০০৯ সালে ফের সেই কেন্দ্র থেকে জেতেন তিনি। ২০০৪ সালেই লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস থেকে প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours