যে কোনও দিন দুপুরে আপনি ফোন পেতে পারেন আয়কর দফতর থেকে। সেই ফোনে কোনও আয়করকর্মী জানতে চাইতে পারেন, আপনার প্যান কার্ড নম্বর। জানতে চাইতে পারেন, আপনার আধার কার্ড প্যানের সঙ্গে লিঙ্ক করা আছে কি না... ইত্যাদি। আপনি হয়তো জানালেন, আপনার প্যান এবং আধার নম্বর লিঙ্ক করা আছে। তাতেও নাছোড়বান্দা ওই আয়করকর্মী জানাবেন, তাঁদের নথিতে লিঙ্ক থাকার কোনও প্রমাণ নেই। আয়করকর্মী নিশ্চিত হওয়ার জন্য আপনাকে জিজ্ঞাসা করবেন, কোন ফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে লিঙ্ক করার সময়?

এ বার আপনার আশঙ্কিত! বলে দিলেন সেই ফোন নম্বর। ফোনের ওপার থেকে বলা হল, ‘‘আমরা এই নম্বর দিয়ে ফের লিঙ্ক করে দিলাম। আপনার নম্বর সঠিক কি না তা জানার জন্য একটা ওটিপি যাবে মোবাইলে।” আপনার কাছ থেকে সেই ওটিপি বা ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড জেনে নেবেন সেই আয়করকর্মী। গোটা ফোনালাপে ব্যাঙ্ক, টাকা পয়সা বা লেনদেনের দূর দূর তক কোনও যোগ নেই। তাই ভাবলেন, আপনারও আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। বরং ‘লিঙ্ক’ হওয়ার পর আপনি হয়তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ভাবলেন, আয়কর দফতরে দৌড়ঝাঁপ না করেই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ মিটে গেল।
ঘটনার বেশ কয়েক সপ্তাহ পর। আপনি হয়তো তত দিনে ভুলেই গিয়েছেন, আয়কর দফতরের সেই ফোনের কথা। এক দিন দেখলেন, আপনার বাড়িতে পুলিশ এসে হাজির। বা ফোন পেলেন কোনও থানা থেকে বা লালবাজার থেকে। পড়িমরি করে সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন, ব্যাঙ্ক জালিয়াতির কয়েক লাখ টাকা এসেছে আপনার অ্যাকাউন্টে! আপনার নামে, আপনার আধার এবং প্যান নম্বর দিয়ে তৈরি অ্যাকাউন্ট। যদিও আপনি কস্মিনকালেও জানতেন না, এ রকম একটা অ্যাকাউন্ট আছে আপনার।
এই ঘটনা কিন্তু কোনও কল্পগল্প নয়। পুরোটাই কুখ্যাত জামতাড়া গ্যাংয়ের নয়া কৌশল। আয়কর আধিকারিকের পরিচয় দিয়ে ফোন করছে সেই প্রতারকরাই। আমার-আপনার আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড নম্বর দিয়ে তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট। আর সেই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে জালিয়াতির টাকা লেনদেনে। মূল অপরাধী থাকছে অধরা। হেনস্থার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পর পর ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের জালিয়াতি দমন শাখার আধিকারিক এবং পুলিশের কর্তাদের ধারণা— কোভিডে সারা দেশের অর্থনীতি ধাক্কা খেলেও ফুলেফেঁপে উঠেছে জামতাড়া গ্যাং। লকডাউন এবং কোভিডের মরসুমে দেশ জুড়ে কমপক্ষে ১৫০-২০০ কোটি টাকার প্রতারণা করেছে জামতাড়া-দেওঘর-কারমাটাঁড়ে ঘাঁটি গেড়ে থাকা কয়েকশো প্রতারণা গ্যাং। 
কী ভাবে হচ্ছে প্রতারণা?
গোটা দেশে অনলাইন প্রতারণার সবচেয়ে বড় হাব এখন জামতাড়া। গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক নতুন নতুন কৌশল আমদানি করে চলছে প্রতারণা। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার প্রসারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের আপডেট করেছে প্রতারকরাও। একটি প্রথম সারির বেসরকারি ব্যাঙ্কের জালিয়াতি দমন শাখার এক শীর্ষ আধিকারিক, কয়েক জন পুলিশ কর্তা বর্ণনা করেন জামতাড়া গ্যাংয়ের নয়া কৌশল।
বাল্ক এসএমএস
ওই আধিকারিকের কথায়, ‘‘অর্থনীতির ভাষায় প্রায় জিরো ইনভেস্টমেন্টে এটা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। মাত্র ৩ হাজার ৪৫০ টাকা খরচ করলে ৫০ হাজার বাল্ক এসএমএস করা যায়। প্রতি ১৫ দিন অন্তর এ রকম ৫০ হাজার বাল্ক এসএমএস করছে প্রতারকরা। ফোন নম্বরের কোনও নির্দিষ্ট ডেটাবেস ধরে নয়, পর পর নম্বর ধরে করা হচ্ছে বাল্ক এসএমএস। কোনওটায় বলা হচ্ছে, আপনার কার্ডের পাসওয়ার্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। কোথাও কেওয়াইসি আপডেট করতে বলা হচ্ছে। কোথাও বা রেস্তরাঁর অনলাইন কাবার ডেলিভারির টোপ।’’
টেলি কলিং সার্ভিস
বাল্ক এসএমএসে দেওয়া থাকছে প্রতারকদের একটি ফোন নম্বর। দেওঘরের এক পুলিশ আধিকারিক যিনি সম্প্রতি জামতাড়া গ্যাংয়ের এক বড় মাথাকে পাকড়াও করেছেন, তিনি বললেন, ‘‘এদের টার্গেট থাকে মাত্র ১০ শতাংশ। অর্থাৎ ৫০ হাজারের মধ্যে পাঁচ হাজার যদি ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারকদের ফোন করে তা হলেই কেল্লা ফতে। তার মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশের ওরা প্রতারণা করতে পারে।” জামতাড়া গ্যাংয়ের টেলি-কলাররা বিভিন্ন কৌশলে হয় ‘টার্গেট’-র কাছ থেকে অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্য হাতিয়ে নেয়, নয়তো এনি ডেস্ক বা টিম ভিউয়ারের মতো অ্যাপের লিঙ্ক পাঠিয়ে টার্গেটকে সেই অ্যাপ ডাউন লোড করিয়ে নেয়। ওই অ্যাপগুলোর সাহায্যে প্রতারকের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে টার্গেটের মোবাইল। পুলিশ এবং ব্যাঙ্ক কর্তাদের দাবি, গত কয়েক মাসে সব চেয়ে বেশি প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে পেটিএমের কেওয়াইসি আপডেটের নাম করে।
ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট
লকডাউনের সময়ে প্রায় সব বেসরকারি ব্যাঙ্ক এবং বেশ কিছু রাষ্ট্রাত্ব ব্যাঙ্ক ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ করে দেয় গ্রাহকদের। ওই পদ্ধতিতে বাড়ি বসেই, অনলাইনে আধার কার্ড এবং প্যান কার্ডের সাহায্যে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ভুয়ো আয়কর আধিকারিক সেজে এরা বিভিন্ন মানুষের প্যান এবং আধার কার্ড নম্বর জোগাড় করে খুলে নিচ্ছে ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট। সেই অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ থাকছে প্রতারকদের হাতে। এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘বেশ কয়েকটা গ্রেফতারির সময় প্রতারকরা টাকা যে অ্যাকাউন্ট থেকে তুলছে, সেই নম্বর তদন্তে সাহায্য করেছে পুলিশকে। তাই পুলিশকে ধোঁকা দিতে এ বার অন্যের নামে খোলা ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে প্রতারণার টাকা লেনদেন শুরু করেছে জামতাড়া গ্যাং। ফলে পুলিশ গিয়ে পাচ্ছে আর এক ধরনের প্রতারিতদের যাঁদের অজান্তেই তৈরি হয়েছে অ্যাকাউন্ট। আড়ালে থেকে যাচ্ছে মূল প্রতারকরা।
জামতাড়া— গ্যাং না প্রতারকদের একটা নেটওয়ার্ক?
গোটা দেশ জুড়ে জামতাড়া গ্যাং কুখ্যাত হলেও, এটি একটি নির্দিষ্ট কোনও গ্যাং নয়। বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানায় এক সময়ে যে জায়গাগুলো ছিল বাঙালির স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য বিখ্যাত, সেই জামতাড়া, কারমাটাঁড়, দেওঘর, নারায়ণপুরের প্রায় প্রতি গ্রামেই চলছে অতি লাভজনক এই প্রতারণার ব্যবসা।
ভাগ বাঁটোয়ারা
কলকাতা পুলিশের এক গোয়েন্দাকর্তা বলেন, ‘‘সম্প্রতি নারায়ণপুর ব্লক থেকে ঝাড়খণ্ড পুলিশ আনোয়ার আনসারি নামে প্রতারণা চক্রের বড় মাথাকে পাকড়াও করে। আনোয়ার আনসারি যে সে লোক নন। সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা ভোটে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার টিকিটে বিধানসভা ভোটেও প্রার্থী ছিলেন তিনি। ভোটে হেরে গেলেও, এলাকায় নেতা হিসাবে দাপট অনেক। পুলিশের দাবি, আনোয়ারের একটা বড় দল আছে। সেখানে কম করে ৪০-৫০ জন টেলি কলার রয়েছে। তাঁকে জেরা করে জানা গিয়েছে, এখন প্রতারণার টাকা ভাগ বাঁটোয়ারা হচ্ছে ৪০-৪০-২০ শতাংশ হিসাবে। যে ফোন করে টার্গেটকে ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করছে, সে পাচ্ছে ৪০ শতাংশ টাকা। কারণ, তার সরাসরি প্রতারণায় যোগ। তার ধরা পড়ার ঝুঁকি বেশি কারণ সে ফোন ব্যবহার করছে।
লুঠের ৪০ শতাংশ পাচ্ছে যার মাধ্যমে টাকা তোলা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রেও যুক্তি, তার ধরা পড়ার ঝুঁকি বেশি। কারণ, সেখানেও মোবাইল ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্য দিকে বাকি ২০ শতাংশ পাবে আনোয়ার আনসারির মতো লোক। কারণ তিনি নতুন কৌশল উদ্ভাবন করছে। পরিকল্পনা তাঁর। কিন্তু তিনি থাকবেন আড়ালে। তাঁর সঙ্গে প্রতারণার সরাসরি কোনও যোগসূত্র থাকবে না। গ্রেফতার হলেও, পরে আদালতে টিকবে না অভিযোগ।
প্রতারকদের রোজগারের ছোট্ট একটা উদাহরণ দেন দেওঘরের এক পুলিশ আধিকারিক। তিনি বলেন, ‘‘মে মাসে মাঝারি মাপের গ্যাংয়ের এক পাণ্ডাকে পাকড়াও করেছিলাম। জেরা করতে গিয়ে জানা গেল নগদ ২০ লাখ টাকা দিয়ে সে একটা গাড়ি কিনেছে ধরা পড়ার ক’দিন আগেই! তা হলেই বুঝুন রোজগারের পরিমাণ।”

Share To:

kakdwip.com

Post A Comment:

0 comments so far,add yours