মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জ, যেখানে সেল্ফ ম্যাপড অর্থাৎ যাঁদের ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে, তাঁদের সংখ্যা মাত্র ৬৮ হাজার ৪৯৯। তার মানে ২০০২ সালের পর যাঁদের নাম উঠেছে, তাঁরাই প্রজেনি ম্যাপড। এবার দেখা যাচ্ছে কমিশনের পরিসংখ্যানে, এই প্রজেনি ম্যাপড ভোটারের সংখ্যাই ১ লক্ষ ৬৩ হাজার ৪৩৪।
'প্রজেনি ম্যাপিং' কী? ফর্ম ডিজিটাইজেশনের পর কোন তাজ্জব তথ্য এখন মাথাব্যথা কমিশনের
প্রজেনি ম্যাপিং
এসআইআর-এর দুটো ধাপ পেরিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ ফর্ম বিলির পর তা সংগ্রহ, তারপর ডিজিটাইজেশন! BLO-দের ভূমিকা এখানে শেষ, এবার গুরুদায়িত্ব ERO, জেলার নির্বাচনী আধিকারিকদের। এবার ফর্ম খতিয়ে দেখার পালা! আদৌ আপনি কিংবা আমি ভারতের নাগরিক কিনা, আদৌ আবেদনে কোনও ত্রুটি রয়েছে কিনা! মূলত এই ম্যাপিংয়ের ক্ষেত্রে দুটো সমান্তরাল ভাগ রয়েছে। একটি সেল্ফ ম্যাপড, অর্থাৎ যাঁদের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় রয়েছে। সেটা কমিশনের কাছে খুব একটা নাড়াচাড়া করার বিষয় নয়, জলের মতো পরিস্কার! দ্বিতীয়ত, প্রজেনি ম্যাপিং, সর্বাধিক এই বিষয়টির ওপরেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে! এসআইআর প্রক্রিয়ার মধ্যে ‘প্রজেনি’- এই শব্দবন্ধটির সঙ্গে আমরা এখনও সকলে সঠিকভাবে পরিচিত হয়ে উঠতে পারিনি! কী এই প্রজেনি ম্যাপিং? তাতে ঠিক কোন বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে! সেই নিয়েই আজকে ব্রিফিং রুমে আপনাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। সঙ্গে আমি শর্মিষ্ঠা।
প্রজেনি ম্যাপিং কী?
মুর্শিদাবাদে বিধানসভার ফল নিয়ে বিস্ফোরক দাবি শুভেন্দুর, কী বললেন বিরোধী দলনেতা?
সোমবার ডিইও-দের বিশেষ কিছু নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। মঙ্গলবার ‘প্রজেনি ম্যাপিং’ সংক্রান্ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম নেই, বাবা-ঠাকুরদার নামে ফর্ম ফিলাপ যাঁরা করেছেন, তাঁদের ফর্ম খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটাকেই নির্বাচন কমিশনের ভাষায় বলা হচ্ছে প্রজেনি ম্যাপিং। মূলত, যে সমস্ত বুথে বংশগত মিল বেশি পাওয়া যাচ্ছে, এমন বুথ ফের খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কী কী তথ্য যাচাই চলছে?
ফর্মে দেওয়া পরিবারের সদস্য বা উত্তরাধিকারীদের তথ্য সঠিক কি না।প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংযুক্ত আছে কি না (যেমন জন্মসনদ, আধার/ভোটার/আইডি, সম্পর্কের প্রমাণ, সঙ্গে নাম, বয়স, ঠিকানা, সম্পর্ক ইত্যাদিতে কোনও ভুল বা অসঙ্গতি আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মৃত এবং ডুপ্লিকেট ভোটার নিয়েও তথ্য দিয়েছে সিইও দফতর।
কমিশনের ‘তাজ্জব’ তথ্য
নথি বলছে, মঙ্গলবার বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত মোট ৪৬ লক্ষ ২০ হাজার এনুমারেশন ফর্ম ফিরেছে। এর মধ্যে ২২ লক্ষ ২৮ হাজার মৃত। নিখোঁজ ৬ লক্ষ ৪১ হাজার। স্থানান্তর, অর্থাৎ যাঁরা অন্যত্র চলে গিয়েছেন ১৬ লক্ষ ২২ হাজার। ডবল এন্ট্রি ১ লক্ষ ৫ হাজার! প্রায় একশো শতাংশ ফর্ম ডিজিটাইজ হয়ে গিয়েছে, এমন পোলিং স্টেশনের সংখ্যা ২২০৮টি।
কমিশনের হাতে যে তথ্য এসেছে, তা তাজ্জব করার মতো। বিশেষত ৫০ টি বিধানসভা এলাকা! যেখানে ২০০২ সালের পর ভোটার হয়েছে, এমন ভোটারের সংখ্যা সবথেকে বেশি। শতাংশের বিচারে সেটি কোথাও ৬২ শতাংশ, কোথাও আবার ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ ২০০২ সালের আগে ওই ৫০ টি বিধানসভায় ভোটার ছিলেন মাত্র ৩৫ শতাংশ! তাহলে ওই ৬৫ শতাংশের মধ্যে কোনও অনুপ্রবেশকারী নেই তো? তাই তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রজেনি ম্যাপিং বা বংশগত মিল বেশি হয়েছে, এমনই বুথই এখন কমিশনের স্ক্যানারে।
জলে দুধ না দুধে জল?
একটু উদাহরণ দিই আপনাদের। ধরুন, একজনের বয়স ২০২৫ সালে ৫০ বছর। কিন্তু ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় তাঁর নাম নেই। অর্থাৎ তিনি প্রজেনি ম্যাপড! এমনও দেখা যাচ্ছে, এমনও বিধানসভা রয়েছে, যেখানে প্রজেনি ম্যাপড ২০০ শতাংশের বেশি।
যেমন মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জ, যেখানে সেল্ফ ম্যাপড অর্থাৎ যাঁদের ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে, তাঁদের সংখ্যা মাত্র ৬৮ হাজার ৪৯৯। তার মানে ২০০২ সালের পর যাঁদের নাম উঠেছে, তাঁরাই প্রজেনি ম্যাপড। এবার দেখা যাচ্ছে কমিশনের পরিসংখ্যানে, এই প্রজেনি ম্যাপড ভোটারের সংখ্যাই ১ লক্ষ ৬৩ হাজার ৪৩৪। অর্থাৎ তাঁরা দাবি করছেন, তাঁদের বাবা-মা-ঠাকুরদার নাম ২০০২ সালের তালিকায় ছিল। অর্থাৎ ২০০২ সালের তালিকা অনুসারে এটা কিনা ২৩৮ শতাংশ বেশি! তাহলে প্রশ্ন তো উঠবেই! ওই এলাকায় কি সংখ্যাগরিষ্ঠই ২০০২ সালের পর জন্মগ্রহণ করেছেন? নাকি জল মিশেছে?
আবার মেটিয়াবুরুজ। কমিশনের তথ্য বলছে, এখানে ভোটারের সংখ্যা ২ লক্ষ ৬৩ হাজার ২৯। সেখানে সেল্ফ ম্যাপড ৬৯ হাজার ৪৯৯। প্রজেনি ম্যাপিং ১ লক্ষ ২১ হাজার ২৪১। অর্থাৎ ‘প্রজেনি অন সেল্ফ ম্যাপিং’ প্রায় ১৭৫ শতাংশ।
কমিশনের নজরে রয়েছে সামসেরগঞ্জ, সুতি, রেজিনগর, চোপড়া, বেলডাঙা, ভাঙড়, মেটিয়াবুরুজ, বসিরহাট, দেগঙ্গা। কিন্তু এই সব এলাকায় ভোটার তালিকা খতিয়ে দেখে দেখা যাচ্ছে, ২০০২ সালের পর যাঁরা নাম তুলেছেন, তাঁদের কারোর বয়স ৫০, কারোর বা ৬৫! বয়সের গড়মিলটা বুঝতে পারছেন? ২০০২ সালে কিন্তু তাঁদের ভোটারধিকার প্রয়োগ করার বয়স ছিল, তাহলে কেন পরে নাম?
গত কয়েক মাসে তো প্রায় রোজই এই ধরনের অভিযোগ উঠে আসছে, যেখানে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের নাগরিককে বাবা-মা বানিয়ে ভোটার কার্ড বানিয়ে ফেলেছেন! সেটা প্রতিবেশী হোক, কিংবা শ্বশুর, মামা-কাকা-যেই হোক! এ খবর আর নতুন করে বলার নেই। প্রজেনি ম্যাপিং যেখানে অস্বাভাবিক হারে বেশি হয়েছে, সেই জায়গাগুলো খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
আবাসনে বুথ সংক্রান্ত ইস্যুতে মঙ্গলবারও পদক্ষেপ নিয়েছে কমিশন। যে সব আবাসনে ৮০০ বা তার বেশি ভোটার রয়েছেন এমন আবাসনের খোঁজ করতে বলা হয়েছে। আপাতত এই ‘প্রজেনি’ ম্যাপড ভোটারদের নিয়েই ভাবনা চিন্তা শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। দুধ থেকে জল ছেকে ঠিক কতটা বার করা যাবে, সেটার দেখার।